en

দানাজাতীয় খাদ্য কীভাবে পশুর উৎপাদন বাড়ায়?

উত্তর(১):- eShikhon.com - ইশিখন.কম
SSC- KrishiShikkha- 2nd Chapter
SSC- KrishiShikkha- 2nd Chapter

দ্বিতীয় অধ্যায়
কৃষি উপকরুনণ

ফসল ফলানোর জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক উপাদানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ফসল বীজ ও বংশবিসস্তারক উপকরুনণ। এদের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে আমরা যেমন বছরের পর বছর ফসল উৎপাদন করতে পারি, তেমনি একটি দেশে নতুন ফসল আত্তীকরুনণ ও সংযোজন করতে পারি, একটি ফসলের জীবতাত্ত্বিক গুণাগুণ ধরে রাখতে পারি এবং নানা জীব কৌশল প্রয়োগের মধ্য দিয়ে উন্নততর করে তুলতে পারি।







এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা-

ফসল বীজ ও বংশবিসস্তারক উপকরুনণ ও ধাপগুলো সম্পর্কে বর্ণনা করতে পারব।

ফসল বীজ ও বংশবিসস্তারক উপকরুনণের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে পারব।

মাছের পুকুরের স্বরুপ ও পুকুর প্রস্তুতির ধাপগুলো বর্ণনা করতে পারব।

মাছের পুকুর প্রস্তুতি প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করতে পারব।

পুকুরের বিভিন্ন স্তরের বর্ণনা ও বাস্তুসংস্থান ব্যাখ্যা করতে পারব।

স্থায়ী মৌসুমী ও আঁতুড় পুকুর বর্ণনা এবং এর প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করতে পারব।

মাছর অভয়াশ্রমের গুরুত্ব সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে পারব।

মাছের আবাসস্থল রক্ষায় মৎস্য সংরক্ষণ আইনের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে পারব।

গৃহপালিত পাখির আবাসন স্বরুপ এবং আবাসন তৈরির ধাপগুলো বর্ণনা করতে পারব।

গৃহপালিত পাখির আবাসন তৈরির প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করতে পারব।

গৃহপালিত পাখির খাদ্যের এবং খাদ্যের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে পারব।

গবাদিপশুর খাদ্য ও খাদ্য তৈরির পদ্ধতি বর্ণনা করতে পারব।

গবাদিপশুর খাদ্যের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে পারব।



(৩৬)



প্রথম পরিচ্ছেদ
ফসল বীজ ও বংশ বিস্তারক উপকরুনণ

বীজ উদ্ভিদের বংশবিস্তারের প্রধান মাধ্যম। সাধারণভাবে উদ্ভিদ জন্মানোর জন্য যে অংশ ব্যবহার করা হয় তাকে বীজ বলে। বীজ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পেতে আমরা বীজকে দুভাবে বুঝতে পারি। যথা-

ক) উদ্ভিদতত্ত্ব অনুসারে, উদ্ভিদের নিষিক্ত ও পরিপক্ব ডিম্বককে বীজ বলে। এ ধরনের বীজকে ফসল বীজ বা প্রকৃত বীজ বা উদ্ভিদতাত্ত্বিক বীজও বলে। যেমন:-ধান, গম, সরিষা, তিল, শিম, বরবটি, টমেটো, ফুলকপি, মরিচ, জিরা, ধৈঞ্চা, জাম, কাঁঠাল ইত্যাদি।

খ) কৃষিতত্ত্ব অনুসারে উদ্ভিদের যে কোনো অংশ(মূল,পাতা,কাণ্ড,কুঁড়ি, শাখা)যা উপযুক্ত পরিবেশে একই জাতের নতুন উদ্ভিদের জন্ম দিতে পারে,তাকে বংশবিস্তারক উপকরুনণ বলে।এ ধরনের উপকরুনণকে কৃষিতাত্ত্বিক বীজ বা অঙ্গজ বীজও বলা হয়।যেমন :আমের কলম,আলুর কন্দ,মিষ্টি আলুর লতা,আখের কাণ্ড,পাথরকুচি গাছের পাতা,কাকরুনোলের মূল, গোলাপের ডাল ও কুঁড়ি, আনারসের মুকুট, কলাগাছের সাকার, আদা, হুলুদ, রসুন, কচু ও সকল উদ্ভিদতাত্ত্বিক বীজ।

কাজেই দেখা যায় সকল উদ্ভিদতাত্ত্বিক বীজ কৃষিতাত্ত্বিক বীজের অন্তর্ভুক্ত কিন্তু সকল কৃষিতাত্ত্বিক বীজ উদ্ভিদতাত্ত্বিক বীজের অন্তর্ভুক্ত নয়।



কাজ :
শিক্ষার্থীরা ধান, গম, মুলা, মরিচ ফসলের এবং আলু, আদা, গাঁদা ফুল ও মেহেদীর কাণ্ড ইত্যাদি সংগ্রহ করুনবে এবং শ্রেণিকক্ষে দলীয়ভাবে জমা দিবে।



ফসল বীজ উৎপাদনের ধাপসমূহ :

বীজ উৎপাদন একটি জটিল প্রক্রিয়া।উন্নতমানের বীজ পেতে হলে যথাযথ নিয়ম ও পদ্ধতি অনুসরণ করে বীজ উৎপাদন করতে হবে। ফসল উৎপাদনের জন্য যে সব ধাপ অতিক্রম করা হয় বীজ উৎপাদনের জন্যও সেভাবেই অগ্রসর হতে হবে। পার্থক্য হলো এই যে,বিভিন্ন ফসলের বীজ যেমন-ধান,পাট,গম,মুলা,মরিচ ইত্যাদি উৎপাদনের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত ধাপসমূহের বিশেষ যত্নবান হতে হয় :

১। বীজ জমি নির্বাচন :

বীজ উৎপাদনের জন্য উর্বর জমি নির্বাচন করা উচিত। জমি অবশ্যই আগাছামুক্ত ও আলোবাতাসযুক্ত হতে হবে।নির্বাচিত জমিতে পূর্ববর্তী বছরে একই জাতের বীজের চাষ না হয়ে থাকলে আরও ভালো। নির্বাচিত জমিতে অন্তত ২% জৈব পদার্থ থাকা উচিত।

২। বীজ জমি পৃথকীকরুনণ :

বীজ উৎপাদনের জন্য নির্বাচিত জমি ও পার্শ্ববর্তী একই ফসলের জমির মধ্যে নির্দিষ্ট দূরত্বের ব্যবধান থাকতে হবে।এর উদ্দেশ্য হচ্ছে কাঙ্ক্ষিত শস্য বীজের সাথে যেন অন্য জাতের বীজের সংমিশ্রণ না ঘটে।

৩। বীজ সংগ্রহ :

বীজ সংগ্রহ বীজ উৎপাদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। বীজ উৎপাদনের জন্য অবশ্যই প্রত্যায়িত বীজ সংগ্রহ করতে হবে। বীজ সংগ্রহের সময় নিম্নোক্ত তথ্য জেনে নিতে হবে।

(৩৭)

ক। জাতের নাম

খ। বীজ উৎপাদনকারীর নাম ও নম্বর

গ। অন্য জাতের বীজের শতকরা হার

ঘ। বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা

ঙ। বীজের আর্দ্রতা

চ। বীজ পরীক্ষার তারিখ।

উল্লিখিত তথ্যগুলো একটি গ্যারান্টি পত্রে ট্যাগ লিখে বীজের বস্তায় বা প্যাকেটে রাখা হয়।

৪। বীজের হার নির্ধারণ :

বীজের বিশুদ্ধতা, সজীবতা, অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা, আকার, বপনের সময়, মাটির উর্বরতা শক্তি এসব বিবেচনা করে হেক্টর প্রতি বীজের হার নির্ধারণ করা হয়।

৫। নির্বাচিত জমি প্রস্তুতকরুনণ :

এক এক জাতের বীজের জন্য জমির প্রস্তুতি এক এক রকম হয়ে থাকে। যেমন, রোপা ধানের বীজ উৎপাদন করতে জমি ভালোভাবে করুন্দমাক্ত করে চাষ করতে হবে। আবার গমের বেলায় জমি শুকনো অবস্থায় ৪-৫ বার চাষ করে পরিপাটি করতে হবে। সার প্রয়োগের মাত্রাও এক এক বীজের জন্য এক এক রকম হবে।

৬। বীজ বপন :

নির্বাচিত ফসলের বীজ উপযুক্ত সারিতে বপন করতে হবে। বীজতলায় প্রতিটি বীজ সমান গভীরতায় বপন করা উচিত। কোনো বীজ কত গীভরতায় বপন করতে হবে তা বীজের আকার, আর্দ্রতা ও মাটির উপর নির্ভর করে।

৭। রোগিং বা বাছাইকরুনণ :

বীজ বপনের সময় যতই বিশুদ্ধ বীজ ব্যবহার করা হোক না কেন জমিতে কিছু কিছু অন্য জাতের উদ্ভিদ ও আগাছা দেখা যাবে। অনাকাঙ্ক্ষিত উদ্ভিদ তুলে ফেলতে হবে। তিন পর্যায়ে রোগিং বা বাছাই করা হয়।

ক। ফুল আসার আগে

খ। ফুল আসার সময়

গ। পরিপক্ব পর্যায়ে।

৮। পরিচর্যা :

বীজের উৎপাদনের জন্য খুব বেশি পরিচর্যার প্রয়োজন হয়। নিচে কয়েকটি পরিচর্যার ধরন উলেস্নখ করা হলো।

ক) সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করা

খ) জৈব সার প্রয়োগ

গ) প্রয়োজনমতো সেচ দেওয়া

ঘ)বৃষ্টির পানি বা সেচের পানি জমলে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা

ঙ)আগাছা পরিষ্কার করা

চ) রোগ ও পোকা দমন করা

ছ)সারের উপরি প্রয়োগ করা।

৯। বীজ সংগ্রহ :

বীজ পরিপক্ব হওয়ার পর পরই কাটতে হবে। তারপর মাড়াই করে ঝেড়ে পরিষ্কার করতে হবে।

বংশবিস্তারক উপকরুনণ উৎপাদনের ধাপসমূহ

বাংলাদেশে ফল ও ফুলের চারা অঙ্গজ পদ্ধতিতে উৎপাদনের প্রচলন খুব বেশি। কারণ এসব গাছের বংশবিস্তার প্রকৃত বীজের মাধ্যমে হলে ফুল ফল পেতে সময় বেশি লাগেও মাতৃগাছের বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে না। এ ছাড়া অনেক ফসলের প্রকৃত বীজ দ্বারা বংশবিস্তার ঘটানোও অসম্ভব অঙ্গজ পদ্ধতিতে মূল, কাণ্ড, পাতা, ফুল, শাখা প্রভূতি দ্বারা দ্রুত ও অল্পসময়ে চারা উৎপাদন সম্ভব। তাই এগুলো হলো ফসলের বংশবিস্তারক উপকরুনণ। কিছু কিছু ফসল যেমন- আনারস, কলা, আলু, আদা, হলুদ প্রভৃতির বংশবিস্তারক উপাদান সরাসরি রোপণ করা যায়। আবার কিছু ফসল যেমন-আম, লেবু, লিচু, জামরুল, গোলাপ ইত্যাদির বংশবিস্তারক উপাদান বিভিন্ন ধরনের কলম তৈরির মাধ্যমে প্রস্তুত করে ব্যবহার করা হয়

(৩৮)



নিম্নে বংশবিস্তারক উপকরুনণ তথা কৃষিতাত্ত্বিক বীজ হিসাবে বীজ আলু উৎপাদনের ধাপসমূহ উল্লেখ করা হলো:

বীজ আলু উৎপাদন পদ্ধতি

জমি নির্বাচন ও তৈরি :

বীজ আলুর ভালো ফলন পাওয়ার জন্য সুনিষ্কাশিত বেলে দোআঁশ মাটি সর্বোত্তম। নির্বাচিত জমি অন্যান্য আলু ফসল, মরিচ, টমেটো, তামাক ইত্যাদি সোলানেসি গোত্রভুক্ত ক্ষেত থেকে অন্তত ৩০ মিটার দূরে থাকতে হয়। ৫-৬ টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ভালোভাবে ঝুরঝুরা করে আগাছা মুক্ত করতে হবে। চাষ অন্তত ১৫ সেমি গভীর হতে হবে। মাটি বেশি শুকনো হলে প্লাবন সেচ দিয়ে মাটিতে ‘ জো’ আসার পর আলু লাগাতে হবে।

বীজ শোধন :

হিমাগারে রাখার আগে বীজ শোধন না হয়ে থাকলে অঙ্কুর গজানোর পূর্বে বীজ আলু বরিক এসিড দিয়ে শোধন করে নিতে হবে (১ লি. পানি ৩০ গ্রাম হারে বরিক এসিড মিশিয়ে বীজ আলু ১৫-২০ মিনিট চুবিয়ে পরে ছায়ায় শুকাতে হবে)।

বীজ প্রস্তুতি :

বীজ আলু উৎপাদনের ক্ষেত্রে আস্ত আলু বপন করা ভালো, কারণ আস্ত বীজ রোপনের পর এগুলোর রোগাক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম। আলু কেটে লাগলে প্রতি করুন্তিত অংশে অন্তত ২ টি চোখ অবশ্যই রাখতে হবে। আলু কাটার সময় বারবার সাবান পানি দ্বারা ছুরি বা বটি পরিষ্কার করা উচিত যাতে রোগ জীবাণু এক বীজ থেকে অন্য বীজে না ছড়ায়। বীজ আলু আড়াআড়িভাবে না কেটে লম্বালম্বিভাবে কাটতে হবে।

মাটিতে ঔষধ প্রয়োগ :

ব্যাকটেরিয়া জনিত ঢলে পড়া রোগ প্রতিরোধের জন্য শেষ চাষের পূর্বে প্রতি শতাংশ জমিতে ৮০ গ্রাম স্টেবল ব্লিচিং পাউডার মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া উত্তম।

সার প্রয়োগ :

দুটি কারণে আলুতে সুষম সার প্রয়োগ অত্যাবশ্যক। প্রথমত: সুষম সার প্রয়োগ করলে আলুর উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং উৎপাদিত বীজ আলুর গুণগত মান ভালো হয়। দ্বিতীয়ত: গাছে কোনো খাদ্যোপাদনের অভাবজনিত লক্ষণ সৃষ্টি হলে ভাইরাস রোগের উপস্থিতি নির্ণয় করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে আলু চাষের জন্য নিম্নলিখিত হারে সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন। শেষ চাষের সময় অর্ধেক ইউরিয়া এবং সবটুকু গোবর, টিএসপি, এমপি, জিপসাম, ম্যাগনেসিয়াম সালফেট, জিঙ্ক সালফেট, বরিক এসিড জমিতে মিশিয়ে দিতে হয়। বাকি ইউরিয়া রোপণের ৩০-৩৫ দিন পর গাছের গোড়ায় মাটি তুলে দেওয়ার সময় প্রয়োগ করে সেচ দিতে হবে।

সারের নাম প্রতি শতাংশে
পচা গোবর ৪০ কেজি
ইউরিয়া ১৪০০ গ্রাম
টিএসপি ৯০০ গ্রাম
এমপি ১০৬০ গ্রাম
বরিক এসিড ২৫ গ্রাম
জিঙ্কসালফেট ৫০ গ্রাম
জিপসাম ৫০০ গ্রাম
ম্যাগনেসিয়াম সালফেট –


(৩৯)

বীজ হার ও রোপণ সময় :

বীজহার নির্ভর করে রোপণ দূরত্ব ও বীজের আকারের উপর। সাধারণত প্রতি হেক্টরে ১.৫ থেকে ২ টন বীজ আলুর প্রয়োজন (একরে ৬০০-৮০০ কেজি)।

রোপণ দূরত্ব

দূরত্ব কাটা আলুর ক্ষেত্রে কাটা আলুর ক্ষেত্রে
লাইন থেকে লাইন দূরত্ব ৬০ সেমি ৬০ সেমি
বীজ থেকে বীজ দূরত্ব ২৫ সেমি ১০-১৫ সেমি
সেচ ব্যবস্থাপনা :

মাটির আর্দ্রতার উপর ভিত্তি করে ২-৪ টি সেচ প্রদান করা উচিত। জমিতে পর্যাপ্ত রস না থাকলে বীজ আলুর অঙ্কুরোদগমের জন্য হালকা সেচ দেওয়া যেতে পারে, তবে সেচ বেশি হলে বীজ পচে যাবে। রোপণের ৩০-৩৫ দিন পর ইউরিয়া উপরি প্রয়োগ করে সেচ দিতে হবে কারণ ৩০ দিনের মধ্যে স্টোলন বের হতে শুরু করে। সাধারণত কেইলের ২/৩ ভাগ পানি দ্বারা ভিজিয়ে দিতে হবে।

আগাছা দমন :

রোপণের পর থেকে ৬০ দিন পর্যন্ত আগাছা পরিষ্কার রাখতে হবে। সাধারণত গাছ ছোট অবস্থায় থাকাকালীন আগাছা যথাসম্ভব দমন করে রাখতে হবে। তাছাড়া বথুয়া জাতের আগাছা যেটি ভাইরাস রোগের বিকল্প বাহক হিসাবে কাজ করে তা অবশ্যই নির্মূল করে ফেলতে হবে।

মাটি উঠিয়ে দেওয়া :

ইউরিয়া উপরি প্রয়োগ করে সেচ দেওয়ার পর মাটিতে ‘জো’ আসলে ভেলি বরাবর মাটি উঠিয়ে দিতে হবে। পরবর্তীকালে প্রয়োজনবোধে আরও এক বার এমনভাবে ভেলি বরাবর মাটি উঠিয়ে দিতে হবে যাতে আলু বাহিরে না যায় এবং স্টোলন ও আলু মাটির ভিতরে থাকে।

রোগিং :

চারা গজানোর পর থেকে রোগিং শুরু করতে হবে। রোগাক্রান্ত গাছ শিকড়সহ উঠিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।

রোগবালাই ও পোকা দমন

(ক) আলুর রোগ :

আলুর রোগসমূহের মধ্যে মড়ক রোগ, ব্যাক্টেরিয়া জনিত ঢলে পড়া রোগ, দাঁদ রোগ, কাণ্ড পচা রোগ, ভাইরাসজনিত রোগ অন্যতম। নিম্ন তাপমাত্রা, কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া ও মেঘলা আকাশ আলুর জন্য ক্ষতিকরুন। এতে আলুর মড়ক রোগ (লেইট ব্লাইট) আক্রমন বেশি দেখা যায়। আলু ফসলকে এ অবস্থা থেকে রক্ষা করার জন্য স্পর্শক (কণ্টাক্ট) জাতীয় ছত্রাকনাশক নিয়মানুযায়ী প্রয়োগ করতে হবে।

খ) কাটুই পোকা :

এ পোকার কীড়া আলুর প্রধান ক্ষতিকরুন পোকা। এরা গাছ কেটে দেয় এবং আলু আক্রমণ করে।

খুব সকালে যে সব গাছ কাটা পাওয়া যায় সেগুলোর গোড়ার মাটি সরিয়ে পোকার কীড়া বের করে মারতে হবে।

আক্রমণ তীব্র হলে কৃষি করুন্মকরুন্তার পরামর্শে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।

গ) জাব পোকা :

জাব পোকা গাছের রস খায় এবং ভাইরাস রোগ ছড়ায়। বীজ আলু উৎপাদনের ক্ষেত্রে জাব পোকা দমন অত্যন্ত জরুরি। এজন্য গাছের পাতা গজানোর পর থেকে ৭-১০দিন পর পর জাব পোকা দমনের জন্য অনুমোদিত কীট নাশক প্রয়োগ করতে হবে। জাব পোকার আক্রমণ এড়াতে ৭০-৮০ দিনের মধ্যেই সংগ্রহ করা উত্তম।

ফসল সংগ্রহ এবং পরিচর্যা :

আধুনিক জাতে পরিপক্বতা আসতে ৮৫-৯০ দিন সময় লাগে। তবে বীজ আলুতে সংগ্রহের অন্তত ১০ দিন আগে সেচ দেওয়া বন্ধ করতে হবে।

(৪০)

(ক) হাম পুলিং :

মাটির উপরে গাছের সম্পূর্ণ অংশকে উপড়ে ফেলাকে হাম পুলিং বলে। আলু সংগ্রহের ৭-১০ দিন পূর্বে হাম পুলিং করতে হবে। এতে সম্পূর্ণ শিকড়সহ গাছ উপরে আসবে কিন্তু আলু মাটির নিচের থেকে যাবে। হাম পুলিং এর ফলে আলুর ত্বক শক্ত হয়, রোগাক্রান্ত গাছ থেকে রোগ বিস্তার কম হয় ও আলুর সংরক্ষণগুণ বৃদ্ধি পায়। বীজ আলুতে অবশ্যই হাম পুলিং করতে হবে, তবে খাবার আলুর বেলায় হাম পুলিং জরুরি নয়।

(খ) আলু উত্তোলন :

আলু উত্তোলনের পর পরই বাড়িতে নিয়ে আসা উত্তম। আলু তোলার পর কোনো অবস্থাতেই ক্ষেতে স্তুপাকারে রাখা যাবে না, কারণ ক্ষেতে আলু খোলা রাখলে তা বিভিন্ন প্রকার রোগ ও পোকা দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে (যেমন-সুতলি পোকা ডিম পাড়তে পারে)।

(গ) আলু সংরক্ষণ :

আলু উত্তোলনের পর বাড়িতে এনে সাথে সাথে কাটা, দাগি ও পচা আলু আলাদা করে বেছে ফেলতে হবে। তারপর ৭-১০ দিন মেঝেতে আলু বিছিয়ে রাখতে হবে। অতঃপর আবারও দাগি ও পচা আলু বেছে বাদ দিয়ে ভালো আলু বস্তায় ভরে হিমাগারে পাঠাতে হবে।

এছাড়া বীজ আলু উৎপাদনের আরও কয়েকটি পদ্ধতি আছে। যেমন-

(ক) টিস্যু কালচার পদ্ধতি

(খ) সপ্রাউট ও টপ শুট কাটিং পদ্ধতি

(গ) বিনাচাষে বীজ আলু উৎপাদন

(ঘ) আলুর প্রকৃত বীজ উৎপাদন।

ফসল বীজের গুরুত্ব :

ফসল উৎপাদনে ফসল বীজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে সব ফসল কেবল বীজের মাধ্যমেই ফলানো সম্ভব সে ক্ষেত্রে উদ্ভিদের বংশরক্ষার্থে ফসল বীজের বিকল্প নেই। এছাড়াও-

১। ফসল বীজ ফসল উৎপাদনের মৌলিক উপকরুনণ।

২। ফসল বীজ মানুষসহ পশু পাখির খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

৩। বিশুদ্ধ ফসল বীজ রোগ, পোকামাকড় ও আগাছা বিস্তার রোধ করে।

৪। ফসল বীজের মাধ্যমে উন্নত জাতের ফসল উৎপাদন সম্ভব।

৫। ফসল বীজের মাধ্যমে উদ্ভিদের বংশধারা টিকে থাকে।

৬। কোনো কোনো বীজ ঔষধ হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

৭। ফসল বীজ অনেক শিল্পের কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

বংশবিস্তরক উপকরুনণের গুরুত্ব :

অধিকাংশ ফসলের বংশবিস্তার বীজ দ্বারা অসম্ভব বা সম্ভব হলেও দীর্ঘসময়ের ব্যবধানে ফলন পাওয়া যায়। কাজেই জনবহুল কোনো দেশের জন্য ফসল দ্রুত পাওয়ার জন্য বংশবিস্তারক উপকরুনণ তথা কৃষিতাত্ত্বিক বীজের বিকল্প নেই। এতে উদ্ভিদের মূল, কাণ্ড, শাখা, পাতা, শিকড়, কুঁড়ি ইত্যাদি ব্যবহার করে বংশবিস্তার করা হয় বলে মাতৃগুণাগুণ বজায় থাকে। একই গাছে একাধিক জাতের সংযোজন ঘটানো যায়। যেমন : মিষ্টি ও টক কুল একই গাছে এবং লাল, হলুদ, কালো ও সাদা ফুল একই গোলাপ গাছে ফোটানো সম্ভব। এছাড়াও এ উপরকরুনণ ব্যবহার করে বীজবাহিত রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। অল্প সমযে ও কম খরচে সহজে ফুল, ফল পাওয়া যায়। কাজেই এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

কাজ :

শিক্ষার্থীরা কৃষি উৎপাদনে ফসল বীজ সংগ্রহ করুনবে এবং বীজের বর্ণনা খাতায় লিখবে।

(৪১)



দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
মাছের পুকুর

পুকুর হচ্ছে ছোট ও অগভীর বদ্ধ জলাশয়, যেখানে নিয়ন্ত্রিত উপায়ে মাছ চাষ করা যায় এবং প্রয়োজনে এটিকে সহজেই সম্পূর্ণভাবে শুকিয়ে ফেলা যায়। এক কথায় পুকুর হচ্ছে চাষযোগ্য মাছের বাসস্থান। পুকুরে পানি স্থির অবস্থায় থাকে। তবে বাতাসের প্রভাবে এতে অল্প ঢেউ সৃষ্টি হতে পারে। পুকুরের আয়তন কয়েক শতাংশ থেকে কয়েক একরুন হতে পারে। তবে ছোট ও মাঝারি আকারের পুকুর ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সুবিধাজনক এবং এরা অধিকতর উৎপাদনশীল হয়।

আদর্শ পুকুরের বৈশিষ্ট্য

মাছ চাষের পুকুরের কিছু বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার যেটি চাষ প্রক্রিয়াকে লাভজনক করতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। একটি আদর্শ মাছ চাষের পুকুরের নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো থাকা প্রয়োজন-

১। পুকুরটি বন্যামুক্ত হবে। এজন্য পুকুরের পাড় যথেষ্ট উঁচু হতে হবে।

২। পুকুরের মাটি দোআঁশ, পলি- দোআঁশ বা এঁটেল- দোআঁশ হলে সবচেয়ে ভালো।

৩। সারা বছর পানি থাকে এমন পুকুর চাষের জন্য অধিক উপযুক্ত।

৪। পুকুরের পানির গভীরতা ০.৭৫-২ মিটার সুবিধাজনক।

৫। পুকুরটি খোলামেলা স্থানে হলে ভালো হয় এবং পাড়ে বড় গাছপালা থাকবে না। এতে পুকুর প্রচুর আলো-বাতাস পাবে। ফলে পুকুরে সালোকসংশ্লেষণ বেশি হবে ও মাছের খাদ্য বেশি তৈরি হবে। পানিতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন মিশবে। উত্তর-দক্ষিণমুখী পুকুর সুর্যালোক বেশি পাবে।

৬। পুকুরের তলায় অতিরিক্ত কাদা থাকা উচিত নয়। তলার কাদার পুরুত্ব ২০-২৫ সে.মি. এর বেশি হওয়া ঠিক নয়।

৭। চাষের পুকুরের আয়তন ২০-২৫ শতক হলে ব্যবস্থাপনা সহজ হয় । পুকুরের আকৃতি আয়তাকার হলে ভালো। এতে করে জাল টেনে মাছ আহরণ করা সহজ হয়।

৮। পুকুরের পাড়গুলো ১:২ হারে ঢালু হলে সবচেয়ে ভালো। অর্থাৎ পুকুরের তলা হতে পুকুরের পাড় যতটুকু উঁচু হবে পাড় ঢালু হয়ে পুকুরের তলার দিকে দ্বিগুণ দূরত্বে গিয়ে মিশবে।

মাছ চাষের পুকুরের পানির গুণাগুণ

মাছের বেঁচে থাকা, খাদ্যগ্রহণ ও আশানুরূপ বৃদ্ধির জন্য পুকুরের পানির গুণাগুণ অনুকূল মাত্রায় থাকা দরকার। পুকুরে পানির গুণাগুণকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়।

১) ভৌত গুণাগুণ

২) রাসায়নিক গুণাগুণ।

মাছ চাষে এদের প্রভাব সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো-

(৪২)

১। ভৌত গুণাগুণ

ক) গভীরতা :

পুকুর বেশি গভীর হলে সূর্যের আলো পুকুরের অধিক গভীরতা পর্যন্ত পৌছাতে পারে না। ফলে অধিক গভীর অঞ্চলে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য প্লাংকটন তৈরি হয় না। আবার সেখানে অক্সিজেনের অভাব হতে পারে।অন্যদিকে পুকুর অগভীর হলে গ্রীষ্মকালে পুকুরের পানি অতিরিক্ত গরম হয়ে যায়। এসব কারণে মাছের ক্ষতি হতে পারে ও উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে।

খ) তাপমাত্রা:

তাপমাত্রার বৃদ্ধির উপর মাছের বৃদ্ধির নির্ভর করে। যেমন- মাছের বৃদ্ধি কমে যায়। একারণে শীতকালে পুকুরে সার ও খাদ্য প্রয়োগের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হয়। রুই জাতীয় মাছের বৃদ্ধি ২৫-৩০০ সে. তাপমাত্রা সবচেয়ে ভালো হয়।

গ) ঘোলাত্ব :

কাদা কণার কারণে পুকুরের পানি ঘোলা হলে পানিতে সূর্যালোক প্রবেশে বাধা পায়। এতে করে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়।

ঘ) সূর্যালোক:

যে পুকুরে সূর্যালোক বেশি পড়ে সেখানে সালোকসংশ্লেষণ ভালো হয়। ফলে সেখানে ফাইটোপ্লাংটন বেশি উৎপাদিত হয় ও মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।

২। রাসায়নিক গুণাগুণ

ক) দ্রবীভূত অক্সিজেন:

পুকুরের পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন মাছ চাষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানত ফাইটোপ্লাংকটন ও জলজ উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় যে অক্সিজেন তৈরি করে পুকুরের পানিতে দ্রবীভূত হয়। বায়ুমণ্ডল হতে সরাসরি পানির উপরিভাগেও কিছু অক্সিজেন মিশ্রিত হয়। পুকুরে বসবাসকারী মাছ, জলজ উদ্ভিদ ও অন্যান্য প্রাণী এ অক্সিজেন দ্বারা শ্বাসকার্য চালায়। রাতে সূর্যালোকের অভাবে সালোকসংশ্লেষণ হয় না বলে পানিতে কোনো অক্সিজেন তৈরি হয় না। এজন্য সকালে পুকুরে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায় ও বিকেলে বেশি থাকে। মাছ চাষের জন্য পুকুরের পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমপক্ষে ৫ মিলি গ্রাম/লিটার (৫ পিপিএম বা ১ মিলিয়ন ভাগের পাঁচ ভাগ) থাকা প্রয়োজন।

খ) দ্রবীভূত কার্বনডাই অক্সাইড:

পুকুরে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য ফাইটোপ্লাংকটনের উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত দ্রবীভূত কার্বন ডাই অক্সাইড থাকা প্রয়োজন। তবে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড মাছের জন্য ক্ষতিকরুন। পানিতে কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা ১২ মিলি গ্রাম/লিটারের (১২ পিপিএম) নিচে থাকলে তা মাছ ও চিংড়ির জন্য বিষাক্ত নয়। মাছের ভালো উৎপাদন পাওয়ার জন্য পুকুরের পানিতে ১-২ পিপিএম কার্বন ডাই অক্সাইড থাকা প্রয়োজন।

গ) পিএইচ (pH):

পুকুরের পানির পি এইচ মান নির্ণয় করে অম্লত্ব বা ক্ষারত্বের মাএা বোঝা যায়।মাছ চাষের জন্য পুকুরের পানির পিএইচ ৬.৫ হতে ৮.৫ এর মধ্যে হলে ভালো হয়। ৬.৫ এর নিচে পিএইচ হলে মাছের বৃদ্ধি কমে যায়। পিএইচ ৪ এর নিচে বা ১১ এর উপরে হলে মাছ মারা যায়। পানির পিএইচ কমে গেলে পুকুরে চুন (১-২ কেজি/শতক) প্রয়োগ করতে হবে। পুকুরে ক্ষারীয় অবস্থা বেশি বেড়ে গেলে এমোনিয়াম সালফেট বা তেতুঁল পানিতে গুলে পুকুরে প্রয়োগ করা যেতে পারে।

ঘ) ফসফরাস:

প্রাকৃতিক পানিতে অতি অল্প পরিমাণ ফসফরাস থাকে। এই ফসফরাস ফসফেটে রূপান্তরিত হয়। পরিমিত ফসফেটের উপস্থিতিতে প্রচুর পরিমাণ ফাইটোপ্লাংটন জন্মায়।

(৪৩)

পুকুরের প্রকারভেদ ও এর বিভিন্ন স্তর

পুকুরের প্রকারভেদ

পানি ধারণক্ষমতা, পুকুরে মাছের ধরন, পুকুরের আয়তন ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে পুকুরকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। নিচে পুকুরের প্রধান প্রধান শ্রেণিবিভাগ আলোচনা করা হলো-

১। পানির স্থায়িত্বের উপর ভিত্তি করে পুকুরের শ্রেণিবিভাগ

ক) স্থায়ী বা বার্ষিক পুকুর:

এসব পুকুরে সারা বছর পানি থাকে। এরা অধিক গভীর হয়। এদের মাটি সবসময় পানি ধরে রাধতে পারে। যেমন- এঁটেল ও দোঁআশ মাটির পুকুর। এসব পুকুরে দেশীয় কার্প জাতীয় মাছ, যেমন- রুই, কাতলা, মৃগেল, কার্পিও ইত্যাদির মিশ্র চাষ, গলদা চিংড়ি ও কার্পের মিশ্র চাষ করা যায়।

খ) অস্থায়ী বা মৌসুমি পুকুর:

এসব পুকুরে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় (৩-৮মাস) পানি থাকে। এগুলো বেশি গভীর হয় না। এদের মাটি বেশি সময় পানি ধরে রাখতে পারে না। যেমন- বেলে মাটির পুকুর। এসব পুকুরে দ্রুত বর্ধনশীল মাছ যেগুলো এক বছরের কম সময়ে বাজারজাত করার উপযোগী হয় সেসব মাছ চাষ করা যায়। যেমন- সিলভার কার্প, তেলাপিয়া, সরপুঁটি, শিং, মাগুর ইত্যাদি।

২। চাষকৃত মাছের বয়সের উপর ভিত্তি করে শ্রেণিবিভাগ

মাছের পোনাকে বয়স ও দৈর্ঘ্য অনুপাতে বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগ করা যায়। যথা- ডিম পোনা, রেণু পোনা, ধানী পোনা ও আঙ্গুলে বা চারা পোনা। ডিম ফুটার পরের অবস্থাকে ডিম পোনা বলে। এদের পেটের নিচে একটি থলি থাকে। থলি থাকা অবস্থায় (২-৩দিন) এরা বাইরে থেকে কোনো খাদ্য গ্রহণ করে না। কুসুম থলি শেষ হয়ে যাওয়ার পরবর্তী অবস্থাকে রেণু পোনা বলে। রেণু পোনা আরও বড় হয়ে ধানের মতো আকার (যেমন- ২ বা ২ সে.মি. এর উপর বড়) হলে একে ধানী পোনা এবং আঙ্গুলের মতো লম্বা (৭ সে.মি. এর উপর) হলে একে আঙ্গুলে বা চারা পোনা বলে। এ বিভিন্ন আকারের পোনার প্রতিপালনের জন্য বিভিন্ন পরিবেশের পুকুর প্রয়োজন। নিম্নে এদের বর্ণনা দেওয়া হলো-

ক) আঁতুড় বা নার্সারি পুকুর:

যে পুকুরে রেণু পোনা ছেড়ে ধানী পোনা পর্যন্ত বড় করা হয় তাকে আঁতুড় বা নার্সারি পুকুর বলে। এখানে শতক প্রতি ৫০-১০০ গ্রাম রেণু পোনা ছেড়ে ১৫-৩০ দিন চাষ করা হয়।







(৪৪)

খ) লালন পুকুর:

যে পুকুরে ধানী পোনা ছেড়ে চারা বা আঙ্গুলে পোনা পর্যন্ত বড় করা হয় তাকে লালন পুকুর বলে। লালন পুকুরের আয়তন ২০ থেকে ১০০ শতক ও গভীরতা ১.৫-২ মিটার হতে পারে। এ পুকুরে শতক প্রতি ২৫০০-৪০০০ টি ধানী পোনা ছেড়ে ২-৩ মাস চাষ করা হয়।

গ) মজুদ পুকুর:

এটিই মাছ চাষের প্রধান পুকুর। যে পুকুরে আঙ্গুলে পোনা ছেড়ে বড় মাছে পরিণত করা হয় তাকে মজুদ পুকুর বলে। এর আয়তন ৩০ শতকের উপরে এবং গভীরতা ২-৩ মিটার হয়। এখানে সাধারণত এখানে ১ বছরের উপরে মাছ লালন না করাই ভালো। কারণ খাদ্য দিলেও এ সময়ের পর মাছের বৃদ্ধির হার কম হয়।

এছাড়া আয়তনের উপর ভিত্তি করেও পুকুরকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন- মিনি পুকুর বা ছোট পুকুর (১-৫ শতক), মাঝারি পুকুর (১০-৩০ শতক) এবং বড় পুকুর (৩০ শতকের উপর)।

পুকুরের বিভিন্ন স্তর

পুকুরের পানির বিভিন্ন গভীরতা ভেদে তাপমাত্রা, অক্সিজেন, ও প্লাংকটনের তারতম্য ঘটে। পুকুরে বিচরণকারী বিভিন্ন মাছও বিভিন্ন গভীরতায় থাকে ও খাদ্য গ্রহণ করে। এই সব তারতম্য অনুযায়ী পুকুরকে ৩টি স্তরে ভাগ করা যায়। যথা- (১) উপরের স্তর (২) মধ্যস্তর এবং (৩) নিচের স্তর

১) উপরের স্তর বা উপরিভাগ:

পুকুরের উপরের স্তর যেহেতু বাতাসের সংস্পর্শে থাকে তাই এই স্তরে অক্সিজেনের পরিমাণ বেশি থাকে। পুকুরের উপরের স্তরে ফাইটোপ্লাংকটন বেশি থাকে যেটি মাছের খাদ্য। এই স্তরে সরপুঁটি, কাতলা, সিলভার কার্প, বিগহেড কার্প থাকে ও খাদ্য গ্রহণ করে।

২) মধ্যস্তর বা মধ্যভাগ:

এই স্তরে পানির তাপমাত্রা ও দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ উপরের স্তরের চেয়ে কম থাকে। এই স্তরে ফাইটোপ্লাংকটন ও জু-প্লাংকটন উভয়ই থাকতে পারে। রুই মাছ এই স্তরে থাকে ও খাদ্য গ্রহণ করে।

৩) নিচের স্তর বা তলদেশ:

এই স্তরে দ্রবীভূত অক্সিজেন ও তাপমাত্রা সবচেয়ে কম থাকে। পুকুরের তলদেশে জু-প্লাংকটন, কীটপতঙ্গ, পচা-আবর্জনা, কেঁচো, শামুক-ঝিনুক পাওয়া যায়। মৃগেল, কালবাউশ, কার্পিও বা কমন কার্প, চিংড়ি, পাঙ্গাশ, শিং, মাগুর এই স্তরে বাস করে ও খাদ্য গ্রহণ করে।

কিছু মাছ আছে যারা পুকুরের সকল স্তরেই বিচরণ করে যেমন- তেলাপিয়া। অন্যদিকে গ্রাস কার্প পুকুরের উপরে, পাড়ে বা তলদেশে জন্মানো বিভিন্ন সবুজ উদ্ভিদ খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে।







(৪৫)



কাজ:
শিক্ষার্থীরা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে পুকুরে স্তর ভিত্তিক মাছের অবস্থান ও তাদের খাদ্যা্যভ্যাসের উপর ভিত্তি করে পোস্টার তৈরি করে শ্রেণিতে উপস্থাপন করুন।

নতুন শব্দ :

নার্সারি বা আঁতুড় পুকুর লালন পুকুর মজুদ পুকুর
বার্ষিক মৌসুমি পুকুর




পুকুরের বসবাসকারী জীব সম্প্রদায়

অবস্থান বা বাসস্থানের উপর ভিত্তি করে পুকুরে বসবাসকারী জীব সমপ্রদায় বা জীবকুলকে চার ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-

১) প্লাংকটন:

প্লাংকটন হচ্ছে পানিতে মুক্তভাবে ভাসমান অণুবীক্ষণিক জীব। এরা দুই প্রকার যথা- ফাইটোপ্লাংকটন বা উদ্ভিদকণা ও জু-প্লাংকটন বা প্রাণীকণা। পুকুরের পানির রং সবুজ বা সবুজাভ থাকলে বুঝতে হবে পানিতে ফাইটোপ্লাংকটন আছে। ফাইটোপ্লাংকটনকে এককোষী শেওলাও বলে। কয়েকটি ফাইটোপ্লাংকটনের উদাহরণ হচ্ছে- ক্লোরেলা, এনাবেনা, মাইক্রোসিস্টিস ইত্যাদি। আর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য জু-প্লাংকটন হচ্ছে ড্যাফনিয়া, কপিপোড, রটিফার। পানির রং বাদামি সবুজ, লালচে-সবুজ বা হলদেটে সবুজ থাকলে বুঝতে হবে ফাইটোপ্লাংকটনের পাশাপাশি পুকুরে জু-প্লাংকটনের উপাদানও ভালো। পুকুরে প্লাংকটনের উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত আলো বাতাসের ব্যবস্থা করে নিয়মিত সার ব্যবহার করতে হয়। সার হিসাবে জৈব ও অজৈব এ দুধরনের সারই ব্যবহার করা যায়।







২) সাঁতারু বা নেকটন :

এরা মুক্তভাবে সাঁতার কাটতে পারে। এরা সমস্ত পানিতে চরে বেড়ায় এবং খাদ্য খুঁজে খায় যেমন- মাছ, ব্যাঙ ইত্যাদি। অবশ্য এদের ডিম ও লার্ভার বৈশিষ্ট্য প্লাংকটনের মতো।

৩) তলবাসী বা বেনথোস:

পুকুরের তলদেশে কাদার উপরে বা ভিতরে যে সব জীব থাকে তাদেরকে তলবাসী বা বেনথোস বলে। যেমন- পচনকারী ব্যাকটেরিয়া, শামুক, ঝিনুক ইত্যাদি। তলবাসী প্রাণী পুকুরের তলা থেকে প্লাংকনের পুষ্টি উপাদান নাইট্রোজেন ও ফসফরাস মুক্ত করতে সাহায্য করে। ফলে পানিতে প্লাংকটনের পুষ্টি উপাদান বাড়ে যেটি মাছ চাষের জন্য ভালো।

(৪৬)

৪) জলজ উদ্ভিদ:

পুকুরে বিভিন্ন ধরনের জলজ উদ্ভিদ জন্মায়। যেমন-

ক)শেওলা:

অগভীর পুকুরের তলদেশে বা পুকুর পাড়ে বিভিন্ন ধরনের শেওলা জন্মে।যেমন-স্পাইরোগাইরা,চারা ইত্যাদি।

খ)ভাসমান উদ্ভিদ:

এ সকল উদ্ভিদ পানিতে ভেসে থাকে। এদের মূল মাটিতে আটকানো থাকে না। যেমন- কচুরিপানা, টোপাপানা, খুদিপানা ইত্যাদি।





গ) নির্গমশীল উদ্ভিদ:

এ সব উদ্ভিদের শিকড় পানির নিচে মাটিতে থাকে কিন্তু পাতা ও কাণ্ডের উপরের অংশ বা শুধু পাতা পানির উপর দাঁড়িয়ে থাকে বা ভেসে থাকে। যেমন- শাপলা, পানিফল, শুসনি শাক, আড়াইল।



ঘ) নিমজ্জিত বা ডুবন্ত উদ্ভিদ:

এ ধরনের জলজ উদ্ভিদ পানির তলদেশে থাকে। এদেও শিকড় মাটিতে থাকে। এদের পাতা ও ডাল কখনো পানির উপরে আসে না। যেমন- ঝাঁঝি, কাঁটা শেওলা, নাজাস।





ঙ) লতানো উদ্ভিদ:

এদের শিকড় পুকুরের পাড়ে আটকানো থাকে এবং কাণ্ড, পাতা পানিতে ছড়িয়ে থাকে। যেমন- হেলেঞ্চা, কলমিলতা, মালঞ্চ।







(৪৭)



তৃতীয় পরিচ্ছেদ
মাছ চাষের জন্য পুকুর খনন এবং প্রস্তুতকরুনণ

মাছ চাষের জন্য সর্বপ্রথম যেটি প্রয়োজন তা হচ্ছে নতুন পুকুর খনন অথবা বিদ্যমান পুকুরকে চাষের জন্য প্রস্তুতকরুনণ বা উপযোগীকরুনণ। নিচে এ সম্পর্র্কে আলোচনা করা হলো-

ক. নতুন পুকুর খনন

কোনো স্থানে পুকুর খনন করতে হলে একটি আদর্শ পুকুরের যে বৈশিষ্ট্যগুলো থাকা দরকার যথাসম্ভব সেগুলো বজায় রেখে পুকুর খনন করতে হবে। পুকুর খননের সময় পুকুরটি যথাসম্ভব আয়তকার রাখার চেষ্টা করতে হবে। পুকুরের গভীরতা এমন ভাবে করা প্রয়োজন যেন বছরে ১.৫ থেকে ২ মিটার পানি থাকে। খননের সময় পুকুরের পাড়ের ঢাল ন্যূনতম ১.৫:২ রাখা উচিত। তবে মাটিতে বালির পরিমাণ বেশি হলে ১:৩ করা নিরাপদ। অন্যথায় পুকুরের পাড় ভেঙে গিয়ে অল্প দিনে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়বে। পুকুর খননের স্থানে যদি উপরের মাটি ভালো ও উর্বর হয় তবে পুকুর খননের সময় আলাদা করে সরিয়ে রাখতে হবে। পুকুর খনন শেষ হলে পুকুরের তলায় বালু মাটির উপরে তা বিছিয়ে দিতে হবে। এতে পুকুরের পানি ধারণ ক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে। পুকুরের পাড়ের উপরিভাগে ২.৫ মিটার চওড়া হলে ভালো। পুকুরের উপরিতলের ধার ও পাড়ের মধ্যবর্তী কিছু স্থান ফাঁকা রাখা হয়। ঐ জায়গাটুকুকে বকচর বলে। পুকুরে তলা সমান অথচ একদিকে কিছুটা ঢালু করতে হবে। এতে পানি সেচ ও মাছ আহরণে সুবিধা হবে। নতুন পুকুর খননের পর দরমুজ দিয়ে পিটিয়ে পাড়ের মাটি শক্ত করে দিতে হবে এবং পাড়ে ঘাস লাগিয়ে দিতে হবে। এতে করে পাড় ভেঙে যাওয়ার প্রবণতা কমে যাবে ও বর্ষায় পাড়ের মাটি ক্ষয়ে যাবে না।







পুকুর প্রস্তুতকরুনণ বা মাছ চাষের উপযোগীকরুনণ

পুকুর প্রস্তুতি মাছ চাষের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। মাছ পালনের পূর্বে বিদ্যমান পুকুর সংস্কারের মাধ্যমে ভালোভাবে প্রস্তুত করে নিলে মাছ স্বাস্থ্যসম্মত বসবাসের অনুকূল পরিবেশ পায়। এতে মাছের দ্রুত দৈহিক বৃদ্ধি ঘটে ও রোগ বালাই কম হয়। ফলে মাছ উৎপাদন লাভজনক হয়। পুকুর প্রস্তুতির প্রক্রিয়াটি কয়েকটি ধারাবাহিক ধাপে সম্পন্ন করতে হয়। ধাপ গুলো নিম্নরূপ-

১. পুকুরের পাড় ও তলদেশ মেরামত

পুকুরের পাড় ভাঙা থাকলে অতিরিক্ত বৃষ্টিতে বা বর্ষাকালে বন্যায় মাছ ভেসে যেতে পারে বা রাক্ষুসে মাছ ঢুকতে পারে। তাই পাড় ভাঙা থাকলে মেরামত করতে হবে ও পাড় উঁচু করে বাঁধতে হবে। পাড়ে বড় গাছপালা থাকা উচিত নয় বা থাকলেও তা ছেটে দিতে হবে।

(৪৮)

এতে করে পুকুরে সূর্যের আলো পড়তে পারবে এবং পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি হবে। পুকুর পুরানা হলে তলায় অতিরিক্ত কাঁদা জমা হয়। এ আবস্থায় ২০-২৫ সে:মি: কাদা রেখে অতিরিক্ত কাদা তুলে ফেলতে হবে। পুকুর শুকিয়ে সহজেই তা করা যায়। মাছ চাষের পুকুরে ৩-৪ বছর পর পর একবার শুকানো উচিত।

পুকুর শুকানোর পর কড়া রোদে তলায় ফাটল ধরাতে হবে। সম্ভব হলে পুকুরের তলায় চাষ দিয়ে নিতে হবে। এতে করে পুকুরে তলা থেকে বিষাক্ত গ্যাস, ক্ষতিকরুন ব্যাকটেরিয়া ও পোকামাকড় দূর হবে এবং পুকুরের পরিবেশ ভালো থাকবে। এরপর পুকুরে তলদেশ সমান করে নিতে হবে। পুকুরের তলায় একদিকে কিছুটা ঢালু হলে ভালো হয়। এতে মাছ ধরতে ও জাল টানতে সুবিধা হবে।

২. জলজ আগাছা দমন

পুকুর পাড়ে ও ভিতরে বিভিন্ন আগাছা যেমন-কচুরিপানা, ক্ষুদিপানা, হেলেঞ্চা, কলমি লতা, শেওলা ইত্যাদি থাকলে তা ভালোভাবে পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। আগাছা পুকুরে দেওয়া সার শোষণ করে নেয়, সূর্যের আলো পড়তে বাধা দেয় এবং মাছের স্বাভাবিক চলাচলে বাধা দেয়। আগাছার মধ্যে মাছের শত্রু যেমন-রাক্ষুসে মাছ, সাপ, ব্যাঙ ইত্যাদি লুকিয়ে থাকে ও মাছ ধরে খায়। বি

আরও জানুন:-

কপিরাইট © ২০১৮ রংতুলি চয়েস ইনফো